দৈনিক দিনরাত:সাহিত্য-
ছোটোবেলা থেকেই নজরুল খুব প্রতিভাধর ছিলেন।
জীবনে একক প্রচেস্টায় অনেক কষ্ট করে নিজেকে এত উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। অভাবের সংসারে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল বলেই নজরুলের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। বেঁচে থাকার তাগিদে মাত্র বারো বছর বয়সে যোগ দেন গ্রামের লেটো গানের দলে। গ্রামের মক্তবেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। তারপর আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানে এক বাঙালি পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে যান তিনি। সেই অফিসার তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর হাবিলদার হিসেবে যোগদান করেন। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। কবির বেড়ে ওঠার সময়ে বিশ্বে রাজনীতিতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছিলো। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন। যার কারণে কবিকে আমরা কখনও বিদ্রোহী, কখনও সংস্কারবাদী, কখনও প্রেমিক পুরুষ, কখনও নবীর শান গাইতে কখনও বা শ্যামা সংগীত গাইতে দেখি। কবির বেড়ে ওঠার সময় কবি বারবার প্রত্যক্ষ করেছেন সাম্প্রদায়িক বিভেদের কলুষিত রূপ।
তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে নবযুগ, লাঙ্গল ও ধূমকেতু পত্রিকা।
নজরুলের প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল ‘মুক্তি’। কিন্তু তাকে খ্যাতি এনে দেয় ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতা। ''বিদ্রোহী বল বীর - বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!'' এ কবিতার কারণে পরবর্তীতে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি রচনা করে নজরুল ব্রিটিশ শাসকদের ব্যঙ্গ করেছিলেন। এ কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। তবুও লেখালেখি ছাড়েননি নজরুল। একের পর এক কালজয়ী সব লেখা সৃষ্টি করেছেন। নজরুলের জীবন থেকে সব প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাই আমরা।
নজরুল শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক লিখেছেন। তার লেখা শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ঝিঙেফুল, সঞ্চয়ন, পিলে পটকা, ঘুম জাগানো পাখি, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এবং ছোটদের জন্য নাটকের মধ্যে আছে ‘পুতুলের বিয়ে’।
নজরুলের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং করাচীতে বসবাস এবং সেই সূত্রে ওমর খৈয়াম ও রুমির সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচয় তার জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। আবার করাচী থেকে ফেরার পরে কলকাতাতে কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সাহচর্য তাকে মানবধর্মের এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।
ছোটবেলা থেকেই চাল চলনে ও আচার ব্যবহারে কাজী নজরুলের ঔদাসীন্য দেখে তার গ্রামের লোকজন তাকে ডাকত ‘তারা খ্যাপা’ বলে। কেউ কেউ এতিম নজরুলকে দেখে আদর করে ডাকত ‘নজর আলী’ বলে। দারিদ্য ছিল তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী। আয় রোজগারের জন্যই তিনি তার বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই মসজিদের দায়িত্ব পালন করতেন আজান দিয়ে, নামাজ পড়াতেন ইমামতি করতেন। তিনি জগতের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। কবি নজরুল চঞ্চলমতি ছিলেন বলে কোথাও থিতু হতে পারেননি। আজ হেথা কাল হোথা পরশু অন্যকোথা ঘুরে বেড়িয়েছেন আর মিলেছেন বারো রকম মানুষের সাথে এবং সঞ্চয় করেছেন অদ্ভূত সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তার পড়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল ছিল, তাই যেখানে যা পেতেন পড়ে ফেলতেন সাগ্রহে। এভাবেই তিনি বাংলা, ইংরেজি ও ফার্সি সাহিত্য থেকে রস আহরণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন।
নজরুল নিজে খুব গান গাইতেন।
লিখেছেন তিন হাজারের বেশি গান। করেছেন অভিনয়ও। গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধেও ছিল মুন্সিয়ানা। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধি দেয়। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডি. লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েই রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পেলেও তিনি কিন্তু মোটেই গোমড়ামুখো ছিলেন না। বরং ছিলেন দারুণ হাসিখুশি, চঞ্চল, ছটফটে একজন মজার মানুষ। যখন হাহা করে হাসতেন তখন আশপাশের মানুষের মনেও ছড়িয়ে যেত আনন্দের রেশ। মানুষের ভালোবাসাই দুখু মিয়াকে সব দুঃখ কষ্ট জয় করার প্রেরণা দিয়েছিল।
(সংগ্রহীত)